একফাল্গুন শ্যাম্পুকথা...
ড. অরিন্দম সিংহ
কখনও কখনও এমনটা দেখাই যায় যে, কোনো-এক জাতির সাংস্কৃতিক বৌদ্ধিক চেতনার সঙ্গে কোনও এক অনুষঙ্গ বা প্রসঙ্গ এমন ভাবে জড়িয়ে যায় যে তার সঙ্গে সেই জাতির আত্মচেতনারও যেন-বা-এক অবিচ্ছেদ্য যোগ ঘটে যায়। রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে বাঙালির আত্মসংস্কৃতিতে এমনই ভাবে জড়িয়ে আছে কবি জীবনান্দের নাম। আর ‘বনলতা সেন’ শিক্ষিত বাঙালির মগ্ন চৈতন্যে লগ্ন হয়ে থাকা এমনই এক কবিতা যার রচনার পঁচাত্তর বছর পূর্তি উদ্যাপন কোনো অকিঞ্চিতকর উপলক্ষ তো নয়ই, বরং কবিতা চেতনাকে, কবিতার প্রতি প্রেমকে উস্কে দেওয়া। এই কাজটিই অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করে দেখাল বীরভূমের এক লিট্ল ম্যাগাজিন সৃজনকথা, মোট বারোটি প্রতিষ্ঠিত-অপ্রতিষ্ঠিত কবির কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে।
একজন অনিয়মিত কবিতাপাঠক হিসাবে নবীন কবির কাব্যগ্রন্থ আলোচনার গুরুদায়ভার অর্পন করা হয় এই অভাজনের উপর। এ-এক বিষম দায় –- বিশেষত কবিতার অ্যানাটমি সম্পর্কে অজ্ঞ এক পাঠকের কাছে। যে-তিনটি কাব্যগ্রন্থ আলোচনা করব, সেগুলি হল: সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘একফাল্গুন শ্যাম্পুসকাল’, রামানুজ মুখোপাধ্যায়ের ‘কামব্যাক’ এবং দেবগুরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘যুদ্ধে পোড়া চুল’। এদের মধ্যে দেবগুরু অবশ্য ইতোমধ্যেই বীরভূম জেলায় একজন পরিচিত মুখ। প্রত্যেকটি গ্রন্থেই ১২টি ক’রে কবিতা আছে। সে-অর্থে কাব্যগ্রন্থগুলি কৃশকায়।
সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘একফাল্গুন শ্যাম্পুসকাল’-এ অন্তর্ভূক্ত প্রায় সব ক’টি কবিতাই ভালো। শিরোনামের মধ্যেও একটু অভিনবত্ব আছে। সৌরভের কয়েকটি পংক্তি মনে দাগ কাটে। ...“তোমার জন্য জলকথাদের জড়িয়ে ধ’রে/ ইচ্ছা মাখে/ শিল্পীত-চোখ/ শ্রাবন্তী শীল...” (‘হৃদয়পুর’) অথবা ‘এক পিঠ রোদ এনে দাও’ কবিতায় “স্বপ্নদের প্রতিদিন স্নান করানো প্রয়োজন”-এ এক-অভিনব উচ্চারণ গতানুগতিকতার বিপরীতে।
সৌরভ উপমার ব্যবহারও করেছেন মুন্সীয়ানার সঙ্গে। ‘জলবিছানা’ — এমনই এক উদাহরণ। কখনও-বা কবির মানসে উঠে আসে এক সুররিয়াল ছবি –- “আমি জ্যোৎস্না কুড়োতে থাকি ধানক্ষেতে” (‘নক্ষত্রমুনির আদেশ’)। সবচাইতে যে-কবিতাটি মনোযোগ আকর্ষণ করে তা হল ‘গোধূলি’ নামে কবিতাটি। এক পিপাসার্ত হৃদয়ের আর্তি মাখানো প্রেমোচ্চারণ স্পর্শ করে। কবিতাটিতে “তুমি ছাড়া আর কার চোখে কার
বুকে আছে এমন পতিত জমি/ যেখানে সারারাত সারাদিনমান জেগে থাকে প্রেম, একাকীর/ এ আলো, আমার বড়ো প্রিয় গোধূলি!” এমন পংক্তিগুলি কবির সৎ উচ্চারণ — এবং সৎ উচ্চারণ বলেই আশা জাগে যে, প্রেম ফুরিয়ে যাবার বিষয় নয়। এমন লেখার হাত যাঁর, তাঁর কাছ থেকে আরও অনেক এমন স্মরণীয় পংক্তি বেরোবে –- এমন আশা করাই যায়।
দ্বিতীয় আলোচ্য গ্রন্থটির কবি রামানুজ মুখোপাধ্যায়। কাব্যগ্রন্থ: ‘কামব্যাক’। রামানুজ তাঁর প্রথম কবিতাতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, কবিতাই তাঁর জীবনের অন্বেষণের হাতিয়ার আর ‘নিভৃত আশ্রয়’ – কবিতাকে ঘিরেই তিনি গড়ে তুলতে চান শব্দতপস্যা – যে তপস্যায় সাধনমন্ত্র উচ্চারণের লক্ষ্যই হ’ল আত্মজিজ্ঞাসা। ‘প্রসবকথা’ কবিতায় শব্দের অমোঘ প্রয়োগে রক্তক্ষয় আর যন্ত্রণা ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে। তেমনি, ‘বেড়াল’ কবিতাটিতে রূপকের আত্মান্বেষণ আর অন্তর্লোকের গভীরে সার্চ-লাইট নিক্ষেপ কবির অস্তিত্ব-জনিত দ্বন্দ্ব-সংঘাত আর মনের মধ্যে চলতে থাকা যন্ত্রণাদায়ক ঘর্ষণ-জনিত আহত অনুভূতিকে প্রকাশ করে।
ক্রিকেটীয় পরিভাষার ব্যবহার ক’রে রামানুজ নাম-কবিতা ‘কামব্যাক’-এ চোয়াল শক্ত ক’রে প্রতিকূলতাকে জয় করার কথা বলেছেন। কিন্তু অনবধানতাবশত ‘স্টান্স’ ‘টান্স’ হয়ে গেছে। রামানুজের কবিতা পড়তে পড়তে সমসাময়িকতাকে অনুভব করা যায়। ‘অশান্তিকামী হাওয়া’-য় ‘এই সময়’ ধরা পড়েছে চমৎকার ভাবে। তবে, এ-কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, রামানুজ ছন্দে যখনই লিখছেন, তখনই তাঁর মেজাজ স্বতঃস্ফূর্ত মনে হয়েছে। জানি না ঠিক কি-না, ‘রক্তকরবী’ কবিতায় অরওয়েলীয় চিন্তার আভাস যেন-বা দেখতে পাওয়া যায়। অরওয়েল বলেছিলেন,
‘Truth is the first casualty of war’ । এই বক্তব্যের ছোঁয়া যেন আভাসিত এখানে। ...“ কী ভীষণ অট্টরোলে/ সত্যকে কে খুন করেছে/ চাতুর্যে, কৌশলে”।
কবির সংবেদনশীলতা আর গভীর বোধ-এর পরিচায়ক ‘জোকার’ কবিতাটি। ভয়ের শীতল স্রোত কী ভাবে ত্রস্ত ক’রে রেখেছে আমাদের জীবন, কী ভাবে দ্বিধা-জড়সড় ক’রে রেখেছে আমাদের প্রাত্যহিকতার খোলামেলা মত বিনিময় –- তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই কবিতায়। “তুমিই প্রেরণা হলে আমি লিখি স্বপ্নের ভিতরে/ ঝিনুক চোঁয়ানো পদ্য অফুরন্ত নিয়ন অক্ষরে” (‘তুমিই প্রেরণা’) –- এমন পংক্তি যিনি লিখতে পারেন, তাঁর কাছে প্রত্যাশা বেড়েই যায়।
‘যুদ্ধে পোড়া চুল’ – দেবগুরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একই উপলক্ষে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। দেবগুরুর কবিতা পড়তে পড়তে অনভ্যস্ত চোখেও ধরা পড়েছে তাঁর কবিতা লেখার নিয়মিত অভ্যাস। কবিতায় ম্যাচিরিওটি আছে। শব্দ বা ভাষার প্রয়োগে আছে নৈপুণ্য। ছন্দের হাতটি বেশ ভালো। “উপদ্রুত হাসি”, “স্বপ্নেরা নিহত হলে প্রেম বড়ো খরস্রোতা হয়” বা “প্রভুহীন আহত চপ্পল” (‘আমাদের দিন’) ইত্যাদি খণ্ড-পংক্তি বা সম্পূর্ণ পংক্তি সত্যিই আকর্ষণীয়।
একটু সংকোচের সঙ্গেই বলি, জয় গোস্বামী-পরবর্তী সময়ে কবিতার যে ছাঁদ বা ছন্দ অনেক তরুণ কবিকেই প্রাণিত করেছিল, তারই উত্তরাধিকার যেন কোথাও দেখি। ‘পলাশবন’ কবিতাটি পড়তে পড়তে যেন জয়ের অনেক কবিতাকেই দেখতে পাই। দেবগুরু অবলীলায় আড্ডায়, মেঠো আলোচনায় ব্যবহৃত শব্দ তথাকথিত অশিষ্ট শব্দ ‘ঢপ’ মিথ্যা বা ধাপ্পার প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। প্রেমিকের হা-হা-বিপন্নতা অভিমান আর বিরহকাতরতার ছবি এঁকেছেন নিপুণ দক্ষতায়। “তখন আমি ছাগল তাড়াই পতন ঘেরা জঙ্গলে”... রাখালিয়া প্রেমিকের শূন্যতাকে, বিপন্নতাকে যেন মূর্ত করেছে এই পংক্তিটি।
গ্রন্থে সংকলিত কবিতাগুলির মধ্যে আত্মান্বেষণ যেমন রয়েছে তেমনই প্রবহমান সময় সম্পর্কে সচেতনতাও রয়েছে। ব্যক্তিগত স্মৃতি, আকাঙক্ষা-প্রত্যাশা-প্রাপ্তির জন্য আনন্দ, তৃপ্তি, খেদ প্রকাশিত হয়েছে, অথচ কখনও তা মোটা দাগের গদ্য হয়ে ওঠেনি। কারণ, প্রত্যেক কবিই সমসাময়িকতার সঙ্গে তাঁদের অনুভূতিমালার সংযোগ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। এমনই কয়েকটি পংক্তি: “কবিতার জন্য শুধু ভাত খাই, অথচ প্রতিটি গ্রাসে/ উঠে আসে যুদ্ধে পোড়া চুল”... অথবা ... “ বাতাস উত্তাল। নিষিদ্ধ পাঁচিল.../ বিশ্বাসে মিলায় বস্তু,/ ভাঙে বাস্তুভিটে।/ ছায়া মাখে ধানের পালুই।” এখানে যে-ছবি উঠে এসেছে তা এই রাজনীতি-সংক্ষুব্ধ দীর্ণ গ্রাম-বাংলারই ছবি।
সবশেষে বলি, তিনটি কাব্যগ্রন্থই পড়তে পড়তে এক-আনন্দানুভূতি হচ্ছিল এই ভেবে যে, পশ্চিম বাংলায় এখনও নবীন কবির দল নিভৃতে কবিতা-চর্চা করছেন নীরবে, কোনো চিৎকৃত ঘোষনা ছাড়াই। প্রচারসর্বস্ব দুনিয়ায় হৃদয়বৃত্তির সঙ্গে মস্তিস্কচর্চআর মিশেল ঘটিয়ে যদি এঁরা কবিতাচর্চা চালিয়ে যেতে পারেন, তবে ‘চুপি চুপি একা একা মরে’ যেতে হবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।
v একফাল্গুন শ্যাম্পুসকাল r সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়
v কামব্যাক r রামানুজ মুখোপাধ্যায়
v যুদ্ধে পোড়া চুল r দেবগুরু বন্দ্যোপাধ্যায়
v প্রকাশক : আশাদীপ, কলকাতা – ৯
v প্র তি টি ব ই য়ে র মূ ল্য : ১ ২ টা কা।
No comments:
Post a Comment